ক্ষমতায় থাকায় বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কমপক্ষে ১০০ সংসদ সদস্যকে নিয়ে সঙ্কটে পড়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। সঙ্গত কারণে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিতর্কিত মনোনয়ন পাচ্ছেন না এসব এমপি। শুধু তাই নয়, তাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে শুদ্ধি অভিযানে নেমেছে দল। যেতে পারে তাদের দলীয় পদ-পদবি। এরই অংশ হিসেবে গত ১২ সেপ্টেম্বর বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে আওয়ামী লীগ। যে ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পঙ্কজ দেবনাথের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে আওয়ামী লীগ সেই ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে আরও সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে।
সাম্প্রতিককালে আওয়ামী লীগের বেশ কিছু সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি, দলীয় কোন্দল, টেন্ডারবাজি, বিএনপি-জামায়াতের অনুপ্রবেশকারীদের প্রশ্রয়, নিজস্ব বলয় তৈরি, নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন, খুনোখুনি, জমি দখল, বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদদ, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ, দুর্নীতি ও অনিয়মসহ নানা বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে গণমাধ্যমেও খবরের শিরোনাম হয়েছেন তারা। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিতর্কিত মনোনয়ন পাচ্ছেন না এসব সংসদ সদস্য। শুধু তাই নয়, তাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযানেও নামবে দল। যেতে পারে তাদের দলীয় পদ-পদবি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী) আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী ’৯৬-এ আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে দলে যোগ দেন। এরপর তিনি সংসদ সদস্য ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী হন। হন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও। অথচ তিনি তার নির্বাচনি এলাকা গোদাগাড়ীতে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন করছেন। তার বিরুদ্ধে উপজেলার রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে প্রকাশ্যে কিল-ঘুসি মারার অভিযোগ ওঠে। টাঙ্গাইল-২ আসনের (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনিরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলা ও জোরপূর্বক জমি দখলচেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। টাঙ্গাইল পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের আশেকপুর মৌজার বাসিন্দা শাহানুর ইসলাম চলতি বছরের ১২ মার্চ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন।
বরগুনা-২ (বেতাগী-বামনা-পাথরঘাটা) আসনের সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমনের বিরুদ্ধেও জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় এক বৃদ্ধ তার জমি দখলমুক্ত করে দেওয়ার দাবিতে চলতি বছরের ১০ মার্চ বরগুনা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে জায়নামাজ বিছিয়ে অনশন করেন। এ ছাড়া দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে পিটিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে আলোচনায় আসেন রিমন। গত ১৬ জুলাই কুমিল্লা-৪ আসনের (দেবীদ্বার) সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বিরুদ্ধে কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদকে সংসদ ভবনের পুরনো এমপি হোস্টেলে মারধরের অভিযোগ ওঠে। গত ১৯ মে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ সরকারি মাহতাব উদ্দীন কলেজের দুই সহকারী অধ্যাপককে পেটানোর অভিযোগ ওঠে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের বিরুদ্ধে। গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর ডেমরা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের এক দলিল লেখককে ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম মনু মারধর করেন বলে অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ অনুযায়ী, চেয়ার দিয়ে মারধর করার পাশাপাশি ভুক্তভোগীর মাথা লক্ষ্য করে পানির গ্লাস ছুড়ে মারেন সংসদ সদস্য।
সূত্র বলছে, বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সংসদ সদস্যদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের অনেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের মধ্যে রয়েছেন হাজী সেলিম, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সামশুল হক চৌধুরী, ওমর ফারুক চৌধুরী, মাহফুজুর রহমান মিতা, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, নজরুল ইসলাম বাবু, পঙ্কজ দেবনাথ, আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব। বিতর্কিত এসব সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে দলটি। নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অনেক এমপির আমলনামা ইতোমধ্যে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে এসে পৌঁছেছে। বাকিদের বিষয়েও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে জরিপ চলছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত, দুদকের অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এসব সংসদ সদস্যের কাউকেই আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না। দলীয় মনোনয়ন পেতে তাদের দুদক থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে হবে। কয়েকজন এমপির এমন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সরকার ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা চতুর্থবার জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের সঙ্গে জড়িত যত বড় নেতা ও সংসদ সদস্য হন, তাদের আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না। দলীয় সূত্র বলছে, ইতোমধ্যে বিতর্কিত নেতাদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি তুলে ধরতে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার জরিপ চলছে। এর মধ্যে কোনো কোনো সংস্থা জরিপের ফল দলটির হাইকমান্ডের কাছেও জমা দিয়েছে।
এ ছাড়া সাবেক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগসহ দলের সহযোগী সংগঠনের নেতাদের দিয়েও একটি জরিপ চালানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তৃণমূলের ত্যাগী-পরিশ্রমী ও পরীক্ষিত-পদবঞ্চিত, দুর্দিনে মাঠের আন্দোলন-সংগ্রামের সক্রিয় থাকা নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর কৌশল নিয়েছেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে অনেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে সংগঠনবিরোধী নানা অভিযোগ জমা পড়েছে। মাঠ জরিপে উঠে এসেছে, অনেক সংসদ সদস্যের নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকার অবস্থাও নাজুক। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তারা অনেকেই জনবিচ্ছিন্ন। তারা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে এলাকায় নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন। এতে তৃণমূলের ত্যাগী-পরিশ্রমী ও পরীক্ষিত-পদবঞ্চিত দুর্দিন-দুঃসময়ে আন্দোলন-সংগ্রামের সক্রিয় থাকা অনেক নেতা রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছেন।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্ল্যাহ বলেন, ‘আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উইং কাজ করছে। দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজস্ব বলয়, বিদ্রোহী প্রার্থীদের মদদ দেওয়া, খুনোখুনি, টেন্ডারবাজিসহ যেকোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, যারা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবেন, তারা ভবিষ্যতে শুধু দলীয় সংসদ সদস্য মনোনয়ন থেকেই বঞ্চিত হবেন তা নয়, দলের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদেও থাকতে পারবেন না।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, ‘দলের কোনো এমপি বা নেতার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড প্রত্যাশিত নয়। কেউ যদি দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ কোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে আওয়ামী লীগ। এ ব্যাপারে নেত্রী শেখ হাসিনা কঠোর অবস্থানে রয়েছেন।’এক প্রশ্নের জবাবে হানিফ বলেন, ‘আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় নমিনেশন তো পরের কথা, আগে তো তাকে দলে থাকতে হবে। এক কথায় কেউ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে দল কঠোর ব্যবস্থা নেবে।’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হকের বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘কোনো নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সংসদ সদস্যদের ছাড় দেওয়া হবে না। ভবিষ্যতে মনোনয়ন তো দূরের কথা, তার দলীয় কোনো পদ থাকবে না। নেত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণ, তিনি সবার বিষয়েই খোঁজখবর রাখেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমেও জরিপ চলছে। জরিপে যার যেমন রিপোর্ট, তিনি তেমন ফল ভোগ করবেন।’
এমপি পঙ্কজ দেবনাথের অব্যাহতি প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, ‘তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়নি। দলের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ১৫ দিনের মধ্যে জবাব চাওয়া হয়েছে। তবে এমন আর কারও বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ ওঠে, সেটি দলের কাছে প্রমাণ হলে, তখন দল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু প্রমাণিত হওয়ার আগে কোনো কিছু বলা যাবে না।’